আর্জেন্টিনীয় দার্শনিক রোডলফো কুশ তাঁর El pensamiento indígena y popular en América (1977) বইটিতে আমেরিকা মহাদেশের দার্শনিক চিন্তাধারার যে স্রোতটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, সেটি ইউরোপীয় চিন্তাধারার মূলস্রোত থেকে প্রসূত। তাঁর মতে, “দেশজ চিন্তাধারা খোঁজার অণুপ্রেরণা কেবলমাত্র তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে জানার স্বার্থ নয়, এটি এমন এক প্রয়াস যা, আমার মতে, এখানকার স্থানীয় জনসাধারণের জীবনবোধের সাথে গভীরভাবে জড়িত” (Kusch, 2010, p. lxxv) । আমেরিকায় থাকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থেকে চিন্তা করা কুশের মতে মার্কিনী অস্তিত্ব যে ইউরোপীয় অস্তিত্বের থেকে ভিন্ন এই বিশেষ তাত্ত্বিক মাত্রা বহন করে । এই তাত্ত্বিক পার্থক্যটি তিনি স্প্যানিশ ভাষার একটি ভাষিক এবং ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যের সাথে যুক্ত করেছেন যা ইংরেজিতে নেই — তা হোল ser বনাম estar1। এই বৈশিষ্ট্যটি এবং তত্ত্ববিদ্যার অন্যান্য মূল ধারণাগুলি আমার সহ-অনুবাদক, প্রয়াত মারিয়া লুগোনেস, এবং আমার জন্য কিছু সংপ্রশ্ন তৈরি করেছিল যখন আমরা কুশের বইয়ের অনুবাদ ইংরেজিতে করতে শুরু করেছিলাম। বইটি আমরা পরে Indigenous and Popular Thinking in América (Kusch, 2010) হিসাবে প্রকাশ করেছি।
এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ নিয়ে চর্চা করা এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য নয়, বরং, একটি নির্দিষ্ট চিন্তাশৈলীর মূল ধারণাগুলির অনুবাদ নতুন বিশ্বদর্শন এবং ভাষাগত দিগন্তকে কী ভাবে একে অপরের সাথে নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ করে অভিনব আখ্যায়িকা এবং ঐতিহ্যের জন্ম দেয় সেটিই এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় । গ্যাডিস-রোজের (১৯৯৮) যুক্তিতে তত্ত্বের (concepts) অনুবাদ সেই ধারণাগুলিকে বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার করার আরও একটি পদ্ধতি হতে পারে। এই অধীতীর পরিপ্রেক্ষিতে অনুবাদ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপকে মৌলিক এবং বস্তুগত জীবন প্রদান করে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কুশের কাজের অনুবাদের ক্ষেত্রে, estar (হওয়া) বা আমেরিকার (মহাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র)মতো মূল ধারণাগুলির অনুবাদের সিদ্ধান্ত, অনুবাদের অভ্যাস এবং চর্চা উভয়েরই প্রতিচ্ছবি। এই ধারণা অনুযায়ী অনুবাদ একটি বাস্তব অনুশীলন প্রক্রিয়া যা অনুবাদক এবং পাঠক, উভয়ের ভাষা এবং তাত্ত্বিক পরিকল্পনার (conceptual schema) চিন্তাশৈলীকে শুধু অণুপ্রাণিত করে না, সাথে সাথে গতিশীল সমাজের বিকাশের প্রেক্ষাপটিও তুলে ধরে। অনুবাদের অভ্যাস এবং চর্চাই এই গতির দিক-নির্ধায়ক।
অনুবাদ চর্চা কীভাবে চিন্তাশৈলীকে প্রভাবিত করে তার বর্ণনা আমি কয়েকটি অনুবাদের জন্য কঠিন (difficult-to-translate) ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। দেশজ আমেরিকান2 দার্শনিক ঐতিহ্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য কুশ এই ধারণাগুলিকে সাধারণ লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করেছেন এবং তিনি ভৌগলিক, নান্দনিক এবং তাত্ত্বিক পরিভাষার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। যে কয়েকটি মূল শব্দের ওপর কুশ সবিস্তারে জোর দিয়েছেন এবং আমিও এই আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি তা হোল আমেরিকা (অনুবাদের ক্ষেত্রে যা আমেরিকা মহাদেশ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিসাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে); লাতিন আমেরিকান আধুনিকতার দুই বিপরীত মেরু pulcritud (শৃঙ্খলা বা পরিচ্ছন্নতা) এবং hedor (দূর্গন্ধ); এবং, সর্বোপরি, যা আমি ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি, স্প্যানিশ ভাষায় estar এবং ser মধ্যে পার্থক্য। এই পার্থক্য এবং কেচুয়া ও আইমারা চিন্তাভাবনার ওপর ভিত্তি করে কুশ তাঁর জটিল সত্ত্বাতাত্ত্বিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিনের ব্যবহারের এই শব্দগুলিকে প্রাত্যহিকতার আবর্ত থেকে মুক্ত করে, দার্শনিক মান প্রদান করে, কুশ কেবলমাত্র বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করেননি; পরিবর্ত হিসেবে এই ব্যাপ্তির বাইরে লাতিন আমেরিকার একটি প্রতীক্ষিত বাস্তবের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন; যে বাস্তবের অস্তিত্ব এখন অবধি তৈরী হয়নি। তাঁর শিরোনামের ‘আমেরিকা’ এই অর্থে উচ্চাভিলাষী। একইভাবে আমেরিকার ভবিষ্যত (afterlife) আমরা অনুবাদের মাধ্যমে করা ভাষাগত ঋণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি – যে ব্যাখ্যা এই মহাদেশের আখ্যানকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই রকম অনুবাদের মাধ্যমে আমরা আধিপত্যবাদী ভৌগোলিকতার একটি বিকল্প দেখতে পাই। যদি একটি ঝকঝকে, বর্ধিষ্ণু আমেরিকা নিজের জাতি রাষ্ট্র, জাতীয় সীমানা এবং, সম্ভবতঃ, পরিচতিকে সম্মান জানিয়ে প্রচলিত ভূগোলের একটি বিকল্প আখ্যান তৈরী করে, তবে pulcritud এবং hedor নান্দনিকতা এবং নাগরিক পরিকল্পনার অক্ষ বরাবর, এবং ser আর estar তাদের প্রভেদের ভিত্ত্বিতে অন্য একটি বিকল্প সত্ত্বাতাত্ত্বিক আখ্যানের সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
লাতিন আমেরিকান চিন্তাভাবনা, সামাজিক তত্ত্ব এবং দর্শনের উপর বিশেষ মনোযোগ তাই নতুন ধরণের আখ্যানের জন্ম দেয়। কুশের El pensamiento indígena y popular en América-এর অনুবাদ থেকে যে তত্ত্ব উঠে আসে তা ইউরোপীয় এবং ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তাধারার একটি বিকল্প আখ্যান। এই বিকল্প আখ্যানটি লাতিন আমেরিকা থেকে দেখা ইউরোপীয় আধুনিকতার বর্ণনা দিয়ে শুরু । প্রান্তিক অবস্থান থেকে দেখলে ইউরোকেন্দ্রিক আধুনিকতা একদিকে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, প্রগতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ভোগবাদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং অন্যদিকে, অনুভূত অযৌক্তিকতা, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার শোরগোলের মধ্যে একটি বিভাজন বা দ্বৈত বিভাজন সৃষ্টি করে। এর সম্পূরক আখ্যানটি প্রান্তিক অবস্থানের মধ্যে থেকেও আমেরিকার একটি কাল্পনিক ধারণাকে উপস্থাপন করে যার উৎস মহাজাগতিক অস্থিতিশীলতা এবং দৈনন্দিন জীবনের যুক্তি, যে যুক্তির অবস্থান ইতিবাচকতা, রৈখিক কারণ, নিউটনীয় কার্যকারণ, আমেরিকান বাস্তববাদ, মন/দেহের কার্তেসিয়ান বিভাজনের পাশাপাশি অন্যান্য দ্বৈতমূলক তত্ত্ববিদ্যার বাইরে। আমরা ভাষার সীমান্তকে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অনুবাদের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা বাধা হিসেবে না দেখে এমন একটি প্রান্তিক হিসাবে দেখেছি যা দুটি ভাষার মধ্যে সংযোগ তৈরী করতে পারে। একটি পাঠ্যের নির্বাচন এবং তার অনুবাদ শুধুমাত্র নন্দনতত্ত্ব এবং শব্দার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন নয়, বরং নীতিশাস্ত্র এবং রাজনীতি এমনকি সম্ভাব্য ভবিষ্যতেরও প্রশ্ন। সুতরাং অনুবাদ, অনুবাদের জন্য কী নির্বাচন করা হবে এবং কীভাবে তা অনুবাদ করা হবে, সেই সিদ্ধান্তগুলিও জ্ঞানতাত্ত্বিক ন্যায়বিচার চর্চার জরুরী প্রসঙ্গ।